শত কোটিপতিদের ক্লাব
বিল ও মেলিন্ডা গেটস এবং শিল্পোদ্যোক্তা ওয়ারেন বাফেট ধনকুবেরদের একত্র করে অভিনব এক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের সম্পদের সিংহভাগ জনকল্যাণে ব্যয় করা। সেই উদ্যোগের সাম্প্রতিক খোঁজখবর জানাচ্ছেন শওকত হোসেন

শতকোটিপতিদের অভিনব ক্লাব, বিলিওনিয়ার ক্লাবের সদস্য এখন ১২২ জন। ক্লাবে যোগ দেওয়ার শর্ত দুটো। সম্পদ হতে হবে কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলার, আর এর অন্তত ৫০ শতাংশ জনহিতে দান করার ঘোষণা দিতে হবে। শর্ত দুটো মেনে চার বছরের মধ্যেই ৫০৪ বিলিয়ন ডলার দান করার ঘোষণা দিয়ে ১২২ জন এই অভিনব ক্লাবে যোগ দিয়েছেন।
ক্লাবটির সদস্যরা এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে মালয়েশিয়া ও ভারত পর্যন্ত বিশ্বের আরও ১২টি দেশ থেকে। এর অর্থ যাচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা গবেষণা, সমাজসেবা ও পরিবেশ রক্ষার মতো কাজে। আফ্রিকা থেকে শুরু করে এই বাংলাদেশেও আসছে সে অর্থ।
ক্লাবের ধারণাটি এসেছিল মূলত বিশ্বের শীর্ষ ধনী মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস আর মার্কিন উদ্যোক্তা ওয়ারেন বাফেটের মাথায়। শুরুটা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে আরো আগে, ২০০৯ সালের ৫ মে-তে। কিছু সংবাদমাধ্যম ওই দিনের একটি গোপন নৈশভোজের কথা ফাঁস করে দেয়। জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন শীর্ষ ধনী নিউইয়র্কে বসে কিছু একটা করেছেন। নামগুলো ছিল চমক-লাগানো। মূল আয়োজক বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেট ছাড়াও তাতে উপস্থিত ছিলেন ডেভিড রকফেলার, নিউইয়র্ক সিটির মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ আর অপরাহ উইনফ্রের মতো খ্যাতিমানেরা।
এ নিয়ে নানা সংবাদ প্রকাশিত হলেও আয়োজকেরা ছিলেন নিশ্চুপ। কিন্তু গোপন ওই নৈশভোজের পরেই জনহিতকর কাজে দানের বিষয়টি নতুন এক ইতিহাস গড়ল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তহবিল সংগ্রহের কাজটি শুরু হলো সেখান থেকেই। যদিও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এল আরও এক বছর পর, ২০১০ সালে।
এরও আগে বসেছিল আরেকটি ছোট বৈঠক। মার্চ ২০০৯-এর একটি দিনে বিল গেটস যাত্রাপথে এসে নামেন নেব্রাস্কার ছোট্ট শহর ওমাহায়। এয়ারপোর্টের-সংলগ্ন এক রেস্তোরাঁয় ‘উইজার্ড অফ ওমাহা’ বলে খ্যাত ওয়ারেন বাফেটের সঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া করেন। সেই সাক্ষাৎ ছিল নতুন এক ইতিহাসের সূচনা। এর পরে, ২০০৯ সালের ৪ মার্চ, বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেট যৌথভাবে চিঠি লেখেন আরেক শীর্ষ ধনী ডেভিড রকফেলারকে। চিঠিতে দানশীল ব্যক্তি হিসাবে ৫ মের নৈশভোজে তাঁকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। ডেভিড রকফেলারও এতে যুক্ত হন ।
এবার ২৪ মার্চ এই তিনজনের সই করা আরেকটি চিঠি পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের আরও কয়েকজনের কাছে। ৫ মে রকফেলার ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট হাউজের সে নৈশভোজের কথাই ফাঁস করে দিয়েছিল সংবাদমাধ্যমগুলো। এ উদ্যোগে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন বিল গেটসের স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস। তারপর আর যে দুটি গোপন নৈশভোজ হয়েছিল, তা আর গণমাধ্যম ফাঁস করতে পারেনি। সেসব ভোজসভায় কয়েকটি লক্ষ্য ঠিক করা হয়। বিল, মেলিন্ডা আর বাফেট মিলে ঠিক করেন, তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ফোর্বস-এর করা তালিকার চার শ মার্কিন ধনীকে অর্জিত সম্পদের অন্তত অর্ধেক দান করতে উদ্বুদ্ধ করা। ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন উদ্যোগটি ঘোষণা করা হয়।
এর আনুষ্ঠানিক নাম হয় ‘দ্য গিভিং প্লেজ’ বা ‘দানের অঙ্গীকার’মার্কিন কোটিপতিরা যে এর আগে দান করতেন না তা নয়। টেড টার্নার ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘকে ১০০ কোটি ডলার দিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন। তবে এই ক্লাবের মূল দুই সদস্য দান করার অঙ্গীকার করেন আরও অনেক বেশি। বিল গেটস তাঁর সম্পদের ৯৫ শতাংশ আর ওয়ারেন বাফেট ৯৯ শতাংশ দান করার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এ উদ্যোগ ছিল সম্মিলিত ভাবনার ফসল। শতকোটিপতিদের ক্লাব এরপর সারা বিশে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এ জন্য বিল গেটস আর ওয়ারেন বাফেট চীন ও ভারত সফর করেন। তাঁদের চীন সফর খুব সুখকর হয়নি। তবে ভারতের আজিম প্রেমজি ২২০ কোটি ডলার দানের ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় এসেছেন। ইউরোপের শতকোটিপতিরা এতে যোগ দিলেও সংখ্যা খুব বেশি নয়। এই ক্লাবের সদস্যের তালিকা তাই বলে ছোট নয়। এখানে আছেন মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পল অ্যালেন, মার্কিন চিত্রপ্রযোজক জর্জ লুকাস, সিডনি কিমেল ও স্টিভ বিং, নিউইয়র্কের বিজনেস ম্যাগনেট ও সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ, ওরাকলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ল্যারি এলিসন, অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ ধনী অ্যান্ড্রু ফরেস্ট, হিলটন হোটেল চেইনের সাবেক কো-চেয়ারম্যান ব্যারন হিলটন, ইবের প্রথম প্রেসিডেন্ট জেফরি স্কল, সিএনএনের প্রতিষ্ঠাতা টেড টার্নার, ভার্জিন গ্রুপের রিচার্ড ব্র্যানসন, ফেসবুকের মার্ক জুকারবার্গ, দুবাই-ভিত্তিক আবরাজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সৈয়দ আরিফ মাসুদ নাকভী, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পোতানিন, মালয়েশিয়ার ভিনসেন্ট তান, সুইৎজারল্যান্ডের হানসজর্গ ওয়াইস প্রমুখ। শতকোটিপতিদের ক্লাব গঠনের এই অভিনব ধারণা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দেয়। ১২২ জন ধনীকে একত্র করাটাও সহজ ছিল না। এখনও বিল গেটস আর ওয়ারেন বাফেট কোটিপতিদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করে চলেছেন।
সফল হচ্ছেন, ব্যর্থতাও আছে। বিশ্বে এখন শতকোটিপতিদের সংখ্যা ২,১৭০ জন। এর মধ্য থেকে ১২২ জনকে ক্লাবে নিয়ে আসায় সাফল্যের হার মাত্র সাড়ে পাঁচ শতাংশ। অনেকেই সরাসরি বিল গেটসকে না করে দিয়েছেন। কেউ কেউ এই ক্লাবের আমলাতান্ত্রিক দিকটির সমালোচনা করেছেন। পরিবারের বাধায়ও অনেকে এই দাতাদের এই ক্লাবে আসতে পারেননি।
২০০৭ সালের বিশ্ব-অর্থনীতির মন্দা ও কর্পোরেট দুর্নীতির বিস্তারের পরে সবাই দুর্নাম থেকে বেরোতে চাইছেন। অনেকে নিজেদের বিপুল সম্পদের একটা মানবিক চেহারা দিতে চাচ্ছেন। এমন অবস্থায় ক্লাবটি শতকোটিপতিদের সামাজিক মর্যাদা বাড়াচ্ছে, তাঁদের সুখ্যাতি আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে। ফলে আশা করা যাচ্ছে, বিলিওনিয়রদের ক্লাব আরও বড় হবে; জনহিতে আসবে ধনীদের কোটি কোটি ডলার।
প্রিয় ডেভিড, জনকল্যাণকর কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা দুজন অনেক আলাপ-আলোচনা করেছি। আমরা ভাবছিলাম, আমাদের সমমনা বারোজনের মতো মানুষজন সবাই একসঙ্গে একই আলোচনার টেবিলে বসতে পারলে খুব ভালো হয়। আমাদের লক্ষ্য হবে নিজেদের বিভিন্ন দিকগুলো শেয়ার করা, সঙ্গে এটাও আলাপ করে দেখা যে যাঁরা এখনো একই পর্যায়ে আসেননি, তাঁদের সমর্থন জোগাতে ও উৎসাহিত করতে আরও বেশি কিছু করা যায় কি না। আমরা দুজনই আপনি এবং আপনার পরিবার দাতব্য কাজে যে সম্মিলিত স্পৃহার জন্ম দিয়েছেন তার প্রশংসা করি। সে কারণেই আমরা শুরুতেই আপনার কাছে যেতে চাই, আমাদের এই আলোচনাটি আয়োজনে আপনি আগ্রহী হবেন কি না, তা বুঝতে। আমরা সভাটা নিউইয়র্কে আয়োজন করতে চাই.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন