GuidePedia

0

ও’কথা বললেই কাঁচি দিয়ে পুরুষাঙ্গ কেটে দেবে…তানিয়া হোসেন : খাবার শেষে মুজাহদি আমাকে নিয়ে গেল অটোমান মার্কেটে। অটোমান মার্কেট ব্লু মস্কের নীচে অবস্থিত। মুজাহদি আমাকে ওর বন্ধুর দোকানে নিয়ে গেল। দোকানি আমাকে চা খাওয়াল এবং দোকানির কাছ থেকেই জানতে পারলাম যে ওই স্থানে অটোমান সম্রাটের আমলে ঘোড়দৌড় হত এবং রেস কোর্সের ওই ময়্দানের পাশেই বাজারগুলো অটোমান আমলে গড়ে উঠেছিল। যদিও এখন আর ঘোড়ার রেস হয় না তবুও বাজারটি রয়ে গিয়েছে।
দোকানির সাথে দরাদরি করে কেনাকাটা করলাম। দোকানি যদি বলে পঞ্চাশ লিরা, আমি বলি পাঁচ লিরা। এভাবে তেইশ লিরা দিয়ে কেনাকাটা করলাম। আমি মূলত কিনলাম ‘নাজর’ যা ‘ইভল আই’ নামে পরিচিত। নাজর হচ্ছে এক প্রকারের চোখ যেটা মূলত নীল রঙের হয়ে থাকে এবং এর মাঝে থাকে সাদা, হাল্কা নীল ও কালো রং এর মন। নাজর আসলে তুর্কির তাবিজ। বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে এ তাবিজ সঙ্গে থাকলে অন্যের নজর লাগে না। আমি তেইশ লিরা দিয়ে নজর ও তুর্কি পাথর টারকয়াজ কিনলাম।
কেনাকাটা শেষ করতে করতে পাঁচটা বেজে গেল। মুজাহদি বলল, চলো তোমাকে ট্যাক্সি করে দিই। সেদিন ইস্তাম্বুলে বৃষ্টি হয়েছিল বলে রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম হওয়ার সম্ভাবনা। মুজাহদি আমাকে বলল যে তুমি একটু আগেই রওনা হয়ে যাও না হলে সময় মতো পৌঁছতে পারবে না। ট্যাক্সিতে ওঠার সময় মুজাহদি বলল, তুমি কি জানো যে তোমার মধ্যে সম্মোহন করার ক্ষমতা আছে আর তোমার চোখে আছে মাদকতা। রাতে তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকব।
তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের একটা জায়্গায় খুব মিল আছে এবং সেটা হচ্ছে ট্রাফিক জ্যাম। পথেই চলে যায় সময়। দিনে একটার বেশি কাজ করা যায় না। সাধারণত সুলতান আহমতে থেকে বোসফারাস যেতে চল্লিশ মিনিটের মত সময় লাগে কিন্তু সেদিন একটু সময় বেশি লাগবে অনুমান করে ঘ্ন্টা খানেক আগেই রওনা হয়ে গেলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে একজন ভালো মানুষ বলেই মনে হলো কিন্তু সে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না। ইঙ্গিতে কথা বলারও কোনও উপায় নেই কারন তিনি ট্যাক্সি চালাচ্ছেন। সেদিন ছিল অবর্ণনীয় জ্যাম। আমরা একই জায়্গায় প্রায় ত্রিশ মিনিট বসেছিলাম। আমার অসহায়্ত্ব বোধহয় ট্যাক্সি ড্রাইভারের ভালো লাগছিল না। তাই বোধহয় আমার দিকে সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। আমি যদিও ধুমপান করি না কিন্তু সেদিন করলাম। আমি একটা সিগারেট শেষ করি আর তিনি আরেকটি এগিয়ে দেন। এভাবে প্রায় দু’ঘ্ণ্টা বসে থেকে আমরা পৌঁছলাম বোসফারাসের তীরে। নামার সময় ড্রাইভারকে দশ লিরা টিপস দিলাম এবং সে আমার সাথে একটি ছবি তুলল। এরপর আমি উঠে গেলাম বড় জাহাজে।
বোসফারাস
বোসফারাস হচ্ছে একটি সঙ্কীর্ণ জলাশয়, যা এশিয়া এবং ইউরোপকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং ‘ব্ল্যাক সি’ ও ‘মারমারা সি’-কে বিচ্ছিন্ন করেছে। বোসফারাস অনেকটা ক্রিকের মতো। আমরা তুরস্কের বোসফারাসে ছিলাম। এশিয়ার তুরস্ক ও ইউরোপের তুরস্ক দুধারই দেখা যায়। ‘মারমারা সি’ তুরস্কে অবস্থিত এবং ‘ব্ল্যাক সি’ আন্তর্জাতিক একটি সমুদ্র। এই দুটি সংযোগস্থানের মধ্যবর্তী স্থানকেই বোসফারাস বলে। বোসফারাস ৩১৭ কিলোমিটার লম্বা। বোসফারাসের পানি ৩-৪ কিলোমিটার বেগে চলে। এটা সাধারণত ‘ব্ল্যাক সি’ থেকে ‘মারমারা সি’-এর দিকে ধাবিত হয়। আবহাওয়া খারাপ হলে এ পানির গতি ৮-৯ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
আমরা কনফারেন্সের প্রায় দুশজন এই বোসফারাস ত্রুজিংয়ে যাই। ত্রুজিংয়ে আসে রাতের খাবার ও ব্যালে ডান্স। ত্রুজিং করতে করতে এশিয়া থেকে ইউরোপে সূর্যাস্ত দেখতে পাই। সমুদ্রে, বনে, মাঠে, পাহাড়ে অনেক স্থানেই সূর্যাস্ত দেখেছি তবে এই প্রথম আমি এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে সূর্যাস্ত দেখলাম। বোসফারাস তুরস্ক ছাড়াও রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেইন ও রাশিয়াকে স্পর্শ করেছে। বোসফারাসের তীরে রয়েছে অনেক গাছ-গাছালি, চা বাগান, কফিশপ ও বার। বারে বসে ব্যালে ডান্স দেখবার আনন্দই অন্যরকম। আমরা প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ত্রুজিং করলাম। ক্রুজিং করতে করতে আমি আমার কোলিগদের এয়ারপোর্টে করা আহমেদের প্রশ্নের প্রসঙ্গ তুলে জানতে চাইলাম যে এটা কি তুরস্কে স্বাভাবকি? জবাবে ওঁরা আমাকে বললেন যে ওটা শুধু তুরস্কে না সমস্ত পৃথিবীতেই অস্বাভাবিক। সাথে আরো বললেন যে এরপর থেকে তুমি কাঁচি সাথে নিয়ে ঘুরবে। য্খন কোনো পুরুষ ওই প্রশ্ন করবে তার পুরুষাঙ্গ ওই কাঁচি দিয়ে কেটে দেবে।
বোসফারাস শব্দটি পুরাণতত্ত্ব থেকে এসেছে। কথিত আছে যে জিয়াস তার স্ত্রীর ঈর্ষার হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য তার প্রেমিক ‘ইউ’কে গোরুতে রূপান্তরিত করেন। এটা জিয়াসের স্ত্রী হেরা বুঝে ফেলে এবং হেরা একটি মাছি ছেড়ে দেয়। ‘ইউ’ ওই মাছির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পানিবেষ্টিত অংশটি পেরিয়ে আরেকদিকে আসে, যে কারণেই পানিবেষ্টিত অংশটির নাম হয়: ‘দ্য কাউ’ (বোস) ‘গেইট’ (ফারাস), বোসফারাস এশিয়া ও ইউরোপের প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে থাকে। এশিয়া থেকে ইউরোপের সৈন্য ও ইউরোপ থেকে এশিয়ার সৈন্যকে দু’ মহাদেশে প্রবেশে বাধা প্রদান করে। বোসফারাস তীরে অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে ওঠে এবং সে কারণেই অটোমান সম্রাট বোসফারাস রক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং বোসফারাসের তীরে তৈরি করেন ‘রোমেলি কেল্লা’ ।
ত্রুজিং শেষে শহরে ফিরতে ফিরতে রাত ১২টা বেজে যায়। আমার মাত্র ওই শহরে একদিন পার হয়েছে, তাই পথ-ঘাটের সঙ্গে একেবারেই পরিচিত না। ইস্তাম্বুলে কেউ ট্রাফিক নিয়ম মানে না। সবাই গাড়ি চালান, ফোনে কথা বলেন, আবার কেউ কেউ মোবাইলে এসএমএস  করেন। পথচারী সব সময়ই দৌড়ে রাস্তা পার হন। অনেকটা মৃত্যুকূপ। আমার হোটেলে যেতে হলে বাস স্টপ থেকে বড় একটা রাস্তা পার হতে হয়। আমি অনেক কষ্টে একজনের হাত ধরে বড় রাস্তা পার হয়ে একটু গলির মতো পথে ওপরের হোটেলের সাইনবোর্ড খুঁজতে খুঁজতে হাঁটতে লাগি আর অমনি হঠাৎ করে উল্টে পড়ে যাই, কারণ ইস্তাম্বুলে কেউ ট্রাফিক নিয়ম মানে না বলে পথের মাঝে বড় বড় লোহার কাঁটা দেওয়া থাকে যাতে গাড়ি ভুল পথে চললে চাকা ছিদ্র হয়ে যায়, আমার হিল তাতে লেগে যায় এবং আমি উল্টে পড়ে যায় ও হাঁটু ছিঁড়ে যায়। তাই ইস্তাম্বুলে অবশ্যই রাস্তা পারাপারের সময় ও পাড়ে হাঁটার সময় খুবই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। অসম্ভব পায়ে ব্যথা নিয়ে ঘুমোতে যাই।
রুমেলি কেল্লা
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে আমি টপকাপি প্যালেস ও দোলমাবাচ প্যালেস যাওয়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে যাই। যাওয়ার পথে সাহিল রুমেলি দুর্গের পাশে গাড়ি থামিয়ে বলে তুমি কি দুর্গে উঠতে পারবে? আমি সেদিন হাইহিল পরেছিলাম। আর সঙ্গে তো আগের রাতের পায়ের ব্যথা ছিলই। তবুও সাহস করে বলে ফেললাম পারব।  রুমেলি কেল্লা বোসফারাসের সবচেয়ে সরু এলাকায় নির্মিত। সম্রাট সুলতান আহমতে দ্বিতীয় এটি তৈরি করেন। রুমেলি কেল্লা আনাতোলিয়া কেল্লার বিপরীতে অবস্থিত। অটোমান সম্রাট ইস্তাম্বুলকে রক্ষা করার জন্যই এই দুর্গ তৈরি করেন। দুর্গে বড়-ছোট মিলিয়ে পনেরোটি টাওয়ার রয়েছে এবং পাঁচটি প্রবেশ পথ রয়েছে। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বড় বড় প্রাচীর। পুরো প্রাচীরটার ওপর থেকে দেখলে হয়তো মুহাম্মদ (স.)-এর ‘মুহম্মদ’-এর ‘এম’-এর মতো দেখা যায়। প্রাচীরে রয়েছে সরু সিঁড়ি এবং এর মাঝে রয়েছে সৈন্যদের দাঁড়াবার স্থান। সিঁড়িগুলো সরু ও কোনও রেলিং নেই। আমি হাইহিল পরে, চোটগ্রস্ত পা নিয়ে ঘটঘট করে ত্রিশ মিনিট কসরত করে একেবারে প্রাচীরের চূড়ায় উঠে যাই। এটি ২৫০ মিটার উঁচু। প্রাচীরের দেয়ালে সৈন্যদের দাঁড়াবার জন্য ফাঁকা জায়গা রয়েছে এবং তার পাশে রয়েছে বন্দুক বসাবার স্থান। এখানে আগত দর্শনার্থীরা আমার সাহস দেখে তো একেবারেই বিস্মিত ও স্তম্ভিত। সাহিল বারবার বলছে, তোমার কি হাত ধরব! আমি বললাম প্রয়োজন নেই।
এবার কেল্লা থেকে নেমে আসার পালা। কেল্লা থেকে নামবার সময় দেখি নীচে তাকালেই মাথা ঘুরে যায় । সিঁড়ির পাশে ধরবার কিছুই নেই। কাঁধে বড় ব্যাগ, পায়ে হাইহিল, সরু সিঁড়ি, ২৫০ মিটার দুর্গের চূড়ায় আমি নামতে পারি না। সিঁড়ি এত ছোট যে সাহিল যে আমাকে ধরবে তাও সম্ভব নয়। কারণ দুজন মানুষ কোনও অবস্থাতেই ওই সিঁড়ি দিয়ে হাঁটতে পারবে না। আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিল, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল, আর মনে হচ্ছিল কেন আমি বারবার বিপদে নিজেকে ঠেলে দেই। আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নাম নিয়ে, মন শক্ত করে বারবার নীচে না তাকিয়ে চল্লিশ মিনিটে নীচে নেমে আসি। সাহিল নীচে নেমে আসার পর বলে তুমি এ জন্মে প্রফেসর হলেও আগের জন্মে সৈনিক ছিলে, অটোমান সম্রাটের সৈন্যদেরও তোমার মতো সাহস ছিল না। আমি তোমার মতো সাহসী মেয়ে জীবনে কোনওদিন দেখিনি।
কেল্লা থেকে আমরা সরাসরি চলে আসি টপকাপি প্যালেসে। সেদিন ছিল শনিবার, ছিল শত শত পর্যটকদের ভিড়। আমরাও তৃষ্ণার্ত ছিলাম, তাই পানি কিনবার জন্য পথের ধারের দোকানে দাঁড়াতেই দোকানি জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি টপকাপি প্যালেসে যাবে? আমি জবাবে বললাম, হ্যাঁ। দোকানদার আমাকে বললে যে, তার কাছে প্যালেসের টিকেট আছে একই দাম, আমি চাইলে কিনতে পারি। আমি তো খুশিতে আত্মহারা। দু ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হবে না। কখনো কখনো প্যালেসের কাছে ফোনবুথের পাশে যাঁরা ফোন কার্ড বিক্রি করেন তাদের কাছেও টিকেট পাওয়া যায়।


প্রকাশিত হয়েছে:- ১৫/০৬/২০১৩ | লিখেছেন:- "গণতন্ত্র"


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top