বাংলাদেশের মানুষ যে প্রাণীটিকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে সেটি হলো সাপ। সাপ সম্পর্কে মানুষের ভয় এতই তীব্র যে, অনেকে সাপ শব্দটি শোনা মাত্র লাফ দিয়ে খাট, টেবিল বা অন্য কোণ উঁচু জায়গায় গিয়ে উঠে পড়েন। আবার অন্ধকার ঘরে সাপ মানেই সারা ঘরময় সাপ! সাপ নিয়ে সবার ভয়ের কারণ হলো, সাপ দেখতে যথেষ্ট ভয়ঙ্কর, এবং এর কিছু কিছু প্রজাতি এতই বিষধর যে, এর কামড়ে মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণী খুব দ্রুত মারা যেতে পারে। সাপ (Squamata) উপবর্গের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী।
বাংলাদেশী সাপঃ বাংলাদেশে ঠিক কত প্রজাতির সাপ আছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড : মুহম্মদ আলী রেজা খানের ‘বাংলাদেশের সাপ’ বই অনুসারে এ দেশে সাপের প্রজাতি ৮১ বা তারও কিছু বেশি। আসলে বাংলাদেশে সাপের প্রজাতির সংখ্যা নিয়ে তথ্য বিভ্রাট আছে। কারণ, ড: আলী রেজা খান তার অপর বই ‘বাংলাদেশের বন্যপ্রানী’তে বাংলাদেশে ৭৯ প্রজাতির সাপ আছে বলে উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে ৫২ টি অবিষধর আর ২৭ টি বিষধর প্রজাতির সাপ বলে উল্লেখিত আছে।এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে একই নামে দুই থেকে তিন প্রজাতির সাপের অস্তিত্ব আছে। এ কারণে, বাংলাদেশে সাপের প্রজাতি এত বেশি হলেও আসলে সাপের নাম খুব কমই পাওয়া যায়। যেমন, দুমুখো সাপ বা ব্লাইন্ড স্নেক এর তিনটি প্রজাতি
Typhlops diiardii, T. porrectus ও T. briaminus থাকলেও সবগুলো একত্রে দুমুখো সাপ নামে পরিচিত।
Typhlops diiardii, T. porrectus ও T. briaminus থাকলেও সবগুলো একত্রে দুমুখো সাপ নামে পরিচিত।
সাপ সম্পর্কে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণাঃ
বাংলাদেশে সাপ সম্পর্কে ভুল ধারণার কোন কমতি নেই। এর পিছনে কিছু কারণও রয়েছে। সাপ সম্পর্কে এ দেশের সাধারণ মানুষের যা জ্ঞান, তা এসেছে সাপুড়েদের থেকে। ফলে সাপ সম্পর্কে নানা প্রকার বিভ্রান্তিকর ও অমূলক ধারনা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। নিচে এর কিছু উল্লেখ করা হলোঃ
বাংলাদেশে সাপ সম্পর্কে ভুল ধারণার কোন কমতি নেই। এর পিছনে কিছু কারণও রয়েছে। সাপ সম্পর্কে এ দেশের সাধারণ মানুষের যা জ্ঞান, তা এসেছে সাপুড়েদের থেকে। ফলে সাপ সম্পর্কে নানা প্রকার বিভ্রান্তিকর ও অমূলক ধারনা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। নিচে এর কিছু উল্লেখ করা হলোঃ
১. সাপের মণিঃ সাপের মাথায় এ জাতীয় কোন পাথুরে পদার্থ আদৌ তৈরী হয়না। সাপুড়েরা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে নানা চটকদার কথা বলে। আর মাঝে মাঝে তারা মণি হিসাবে যা দেখায় তা হলো মুক্তা বা অন্য কোন পাথর যা কোনভাবেই মণি নয়।
২. সাপের দুধপানঃ অনেকের ধারণা, দুধরাজ (Elaphe radiate) নামক সাপ গরুর পা পেঁচিয়ে বাঁটে মুখ লাগিয়ে দুধপান করে। কেন এই ধারণার উৎপত্তি? উত্তরটা খুবই সহজ। উপমহাদেশের বেশিরভাগ মানুষ হিন্দু এবং দেবী মনসার বাহন হবার কারণে, সাপকে উচ্চ শ্রেণীর খাদক, এবং সম্মানযোগ্য প্রাণী হিসেবে একটা ধারণা অনেকের মধ্যে প্রচলিত আছে। সাপুড়েরা অতীতে যে কাজটি করতো তা হলো, সাপকে দীর্ঘ সময় পানি থেকে দূরে রেখে তাদের তেষ্টা দারুণভাবে জাগাতো। তারপর জনতার সামনে তৃষ্ণার্ত সাপের সামনে দুধের বাটি রাখতো। বেচারা সাপ তেষ্টার চোটে সেই দুধই পান করতো। এভাবে সাপের দুধপানের বিষয়টি জনমনে প্রচলিত হয়ে গেছে।
৩. প্রতিহিংসাঃ অনেকের ধারণা, সাপ একবার কারও দ্বারা আক্রান্ত হলে সে আক্রমণকারীকে চিনে রাখে এবং রাতে এসে কামড়ে দিয়ে যায়। এটা সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক ধারণামাত্র।
৪. জীহবা দিয়ে শ্রবণঃ সাপ চলাফেরার প্রয়োজনে বার বার জীহবা বের করে তা আসলে শোনার জন্য নয়। সাপের জিহবার অগ্রভাগে ‘জেকবসন অর্গান’ নামে একধরনের গ্রন্থি আছে যদ্বারা সাপ বায়ুস্থ বিভিন্ন পদার্থের অস্তিত্ব অনুভব করে। এটিকে ঘ্রাণ নেয়াও বলা যেতে পারে।
৫. লেজ দিয়ে আঘাতঃ অনেকেরই ধারণা দাঁরাশ (Coluber mucosus) সাপ লেজ দিয়ে আঘাত করে এবং এই আঘাত যেখানে লাগে সেখানে পচন ধরে ইত্যাদী। কিন্তু এই ধারনা সত্য নয়। সাপের মাথা চেপে ধরলে সাপ লেজ দিয়ে হাত পেঁচিয়ে ধরবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দাঁড়াশ সাপের ক্ষেত্রে কোন বিশেষত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উপরন্তু এটি নির্বিষ ও মানুষের উপকারি বন্ধু। কারণ, এদের প্রধান খাদ্য ইঁদুর।
৬. পিচ্ছিল সাপঃ আমাদের দেশের সকলের ধারনা সাপ পিচ্ছিল। কিন্তু এটি সত্য নয়। সাপ পিচ্ছিলতো নয়ই বরং খসখসে। সাপের গা থেকে কোন প্রকার পিচ্ছিল পদার্থ নিঃসৃত হয়না।
৭. সাপের পাঃ আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে ও অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, সাপের পা দেখলে রাজা হওয়া যায়। কিন্তু সাপের কোন পা নেই। তাই সাপের পা দেখে রাজা হবার কোন সম্ভাবনাও নেই।
৮. সাপের ওঝাঃ সাপের ওঝারা যে চিকিৎসা করে তা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। সাপের ওঝার চিকিৎসায় সেই রোগীই ভালো হয় যাকে এমন সাপে কামড় দিয়েছে যার বিষ নেই।
এছাড়াও আমাদের দেশে প্রায় সব সাপকেই বিষধর মনে করা হয়। কিন্তু তা সত্য নয়। যেমন, কালনাগিনী (Chrysopelea ornata) সাপের নাম শুনলেই মনে হয় যে, এই সাপের কামড়ে মৃত্য অনিবার্য, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি একটি নির্বিষ সাপ।
কয়েকটি নির্বিষ সাপের বর্ণনা নিচে দেয়া হলোঃ
অজগরঃ অজগর গোত্রের তিনটি প্রজাতি বাংলাদেশে আছে। এর মধ্যে (Python molurus) একসময় বাংলাদেশের সর্বত্র পাওয়া যেত। বর্তমানে সুন্দরবন এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এই সাপের দৈর্ঘ্য ৫-৬ মিটার। মোটা, গাছের সাথে ঝুলে থাকতে পছন্দ করে। খাবারের জন্য ঘাপটি মেরে বসে থাকে। শিকার কাছে এলে কামড়ে পেঁচিয়ে ধরে চাপ দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলে আস্ত গিলে খায়।
ছবিঃ

ছবিঃ
গোলবাহার, রিগাল বা রেটিকুটেড পাইথন (Python reticulatus): অতি দীর্ঘ সাপ। লম্বায় ৯ মিটারের কিছু বেশি। ৩২ ফুট পর্যন্ত রেকর্ড আছে। সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে সাপটি পাওয়া যায়। সিলেট থেকে শুরু করে পূর্বাঞ্চলের চিরসবুজ বনগুলিতে খুব সামান্য সংখ্যায় হলেও গোলবাহার সাপের দেখা পাওয়া যায়। সাপটি লম্বা হলেও অজগরের মত স্থুল নয়। সরু ধরনের। বিভিন্ন ছোট ছোট বন্যপ্রাণী ধরে খায়।
ছবিঃ

ছবিঃ
ঘরগীন্নি সাপঃ ঘরগীন্নি সাপের তিনটি প্রজাতি আছে এর মধ্যে দুটি বিরল। বাংলাদেশে যেটি বেশী পাওয়া যায় সেটি হলো (Lycodon aulicus)বাংলায় ‘হলুদাভ ঘরগীন্নি সাপ’ (Yellow spectacled Wolf snake)। ঘরদোর, ভাঙা দালান কোঠা, ইঁটের পাঁজা ও গাছের খোরল এদের খুবই পছন্দের জায়গা। এদের গা হালকা বাদামী থেকে ধূসর বা কালো। এদের সামনে দুটি উঁচেউ দাঁত আছে যা দেখে বিষধর মনে হতে পারে। আসলে ঐ দাঁতের সাহায্যে এরা টিকটিকি ইত্যাদী ধরে খায়। এছাড়া (Lycodon jara) নামের ঘরগীন্নি সাপ এ দেশে অল্প বিস্তর দেখা যায়।
ছবিঃ
Lycodon aulicus
ছবিঃ
Lycodon aulicus
Lycodon jara
কুকরী সাপঃ কুকরী সাপের সাতটী প্রজাতি বাংলাদেশে দেখা যায় বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। এর মধ্যে দুটী প্রজাতি দক্ষিণাঞ্চল বাদে বাংলাদেশের সর্বত্র পাওয়া যায়। এই প্রজাতিগুলোর নাম নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
- Oligodon albonincutus
- Oligodon cinereus
- Oligodon taeniolata
- Oligodon theobaldi
- Oligodon dorsalis
- Oligodon cyclurus
- Oligodon arnensis
এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে নিচের দুটি প্রজাতি বাংলাদেশে বেশি পাওয়া যায়।
ছবিঃ

Oligodon cyclurus
- Oligodon albonincutus
- Oligodon cinereus
- Oligodon taeniolata
- Oligodon theobaldi
- Oligodon dorsalis
- Oligodon cyclurus
- Oligodon arnensis
এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে নিচের দুটি প্রজাতি বাংলাদেশে বেশি পাওয়া যায়।
ছবিঃ
Oligodon cyclurus
কালোমাথা সাপ (Sybinophis Sagittarius.): কালোমাথা সাপের গায়ের রঙ ধূসর বাদামী, দেখতে একটা মোটা কেঁচো থেকেও চিকন। সারা শরীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিকচিকে আঁশে ভরা। ঘাড় থেকে মাথার অগ্রভাগ কালো। সাপটির দেখা কদাচিৎ পাওয়া যায়। এই সাপের দুটি প্রজাতি আছে।
ছবিঃ

ঢোঁড়া সাপ (Amphiesma stolata): সারা দেশের যে কোন অঞ্চলে পাওয়া যায়। হলুদে বাদামীতে মেশানো ঢোঁড়া সাপের পিঠের উপর দিয়ে দুটি হলুদ ডোরা চলে গেছে লেজ অবধি। দেহের পিছন ভাগে এই ডরা খুব স্পষ্ট। সারা শরীরের উপর দিয়ে কালো কালো বা বাদামী ছাপ রয়েছে। আরেক প্রজাতির ঢোঁড়া সাপ হচ্ছে (Xenochropis piscator)। এটিও বাংলাদেশের সবখানে পাওয়া যায়। এছাড়া আরেকটি প্রজাতি হলো (Xenochropis cerasogaster)
ছবিঃ 
ঢোঁড়া সাপ (Amphiesma stolata)
ঢোঁড়া সাপ (Amphiesma stolata)
মেটে সাপ বা বাইট্টা সাপ (Atretium schistosum): এটি বাংলাদেশের জলাশয়ের একই সাধারণ ও সহজলভ্য সাপ। এদের মাথা অপেক্ষাকৃত সরু। পেটের পাশ দিয়ে সারা পিঠ জলপাই সবুজ এবং পেট হলুদাভ কমলা রঙের। লম্বায় ৫০০-৬০০ মিমি।
ছবিঃ

ছবিঃ
দুধরাজ (Elaphe radiata): দুধরাজ নাম হলেও এই সাপ দুধ খায় না। এদের প্রধান খাদ্য এদের প্রধান খাদ্য ইঁদুর, টিকটিকি ও পাখি। এদের সংখ্যা খুবই কম। তবে যমুনার পশ্চিমাঞ্চল তথা পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও গাইবান্ধা জেলায় বেশি পাওয়া যায়। গোলাঘরে ইঁদুরের খোঁজে এরা ঢুকে পড়তে পারে। এছাড়া ক্ষেতে খামারে এদের দেখা মেলে।
ছবিঃ

ছবিঃ
ডারাশ (Coluber mucosus): এদের প্রধান খাবার ইঁদুর। এরা মানুষের উপকারি বন্ধু। গায়ের রঙ বাদামী। পূর্বাঞ্চলেরগুলির গায়ের রঙ জলপাই বাদামী। এদের চোখ বড় বড় ও গলা অপেক্ষাকৃত সরু। উপরের ও নিচের চোয়ালে ও গলায় কালো দাগ থাকতে পারে।
ছবিঃ

ছবিঃ
কালনাগিনী (Chrysopelea ornata): বাংলাদেশের একমাত্র কুলীন সাপ। এ কথা বলার কারণ, হলো এই সাপের কথা শুনলেই মনের মাঝে শিহরণ জাগে। ভাবা হয় এই সাপের বিষ অব্যর্থ। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই সাপের কোন বিষ নেই। বাংলাদেশের সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সুন্দরবন অঞ্চলে এদের দেখা মেলে।
ছবিঃ

ছবিঃ
সুন্দরী সাপ (Elachistodon westermanni): বাংলাদেশে এই সাপ এককালে ছিলো বলে ধারনা করা হয়। বর্তমানে এই সাপ বাংলাদেশে আর পাওয়া যায় না। লম্বায় ৮০০ মিমি. পিঠের রঙ জলপাই বাদামী বা কালচে। চোখের মণির সামনে ও পিছনে কালো দাগ থাকে।
ছবিঃ

ছবিঃ
লাউডগা সাপ (Ahaetulla nasutus): এটি লখিন্দরের সাপ বলে পরিচিত। সরু, চিকন, লম্বা, মাথার অগ্রভাগ সুঁচাল একদম সবুজ সাপ। এই সাপ সুতানালী সাপ নামেও পরিচিত। এটি দেশের সর্বত্র পাওয়া যায়। গ্রামের লাউ বা শিমের মাচায় এরা উঠে বসে থাকে।
ছবিঃ

ছবিঃ
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। এরপর বাংলাদেশের কিছু বিষধর সাপ নিয়ে একটা পোস্ট দেয়ার ইচ্ছা আছে। যদি পাঠকগণ উৎসাহ দেন তবে চেষ্টা করতে পারি। এছাড়া এর আগে বাংলাদেশের মাছ নিয়ে তিনটি পোস্ট দিয়েছিলাম। আরও কিছু বাকি আছে। পড়ে দেখবেন আশা করি। আর হ্যাঁ, ভুল হলে ধরিয়ে দেবার জন্য পাঠকগণের প্রতি বিনীত অনুরোধ রইলো।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন