GuidePedia

0
হিজড়ার লাখো দুঃখ

যার সুন্দর একটা শৈশব ছিল। সে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দৌড়াতো-খেলতো। ছোটাছুটি করতো উঠানের এ মাথা থেকে ও মাথা। ক্ষুধা পেলে মায়ের গলা জড়িয়ে খাবার চাইতো। সেই মানুষটা আজ যেন আর মানুষই নয়। যেন অন্য গ্রহ বা ভিন্ন প্রজাতির কেউ। তার নেই মা-বাবা, ভাই বা বোন। জগৎ সংসারে কেউ তাকে স্বজন বলে পরিচয় দেয় না। তার নাম এখন হিজড়া। কচুরিপানা যেমন পানির বুকে আবর্জনা, মানুষের সমাজেও তারা তেমন আবর্জনা। হাসি, সাজগোজ আর হৈ-হুল্লোড়ের আড়ালে তাদের প্রত্যেকেই বয়ে চলেছে আলাদা আলাদা দুঃখ।
হিজড়ার লাখো দুঃখ

ইউএনএফপির সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৫ হাজার হিজড়ার বসবাস। এই ১৫ হাজার হিজড়ার জীবন লাখো দুঃখে ভরপুর। কিন্তু তাদের দুঃখগুলো এক জায়গাতেই এক। তারা এ সমাজের মানুষের নিন্দা আর বঞ্চনার শিকার। পরিবার তাদের গ্রহণ করতে চায় না। সমাজ দিতে চায় না মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি। এরা অনেক সময় নিজের দুঃখগুলো বলে। বলতে গিয়ে খুলে নিজের কষ্টের ঝাঁপি। কষ্টের কথা বলতে গিয়ে মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে যায় হাস্যোজ্জল মুখ। মনে হয় দুঃখ নামের কোনো অক্টোপাস তাদেরকে চারদিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে।

আশা হিজড়া (২৬) থাকেন রায়ের বাজার বেড়িবাঁধে। ধানমন্ডি লেকে বসে কথা হয় তার সঙ্গে। আশা জানালেন তার জীবনের নীল কষ্ট কথা। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করতেই বললেন, আমাদের আবার দেশের বাড়ি। দিনাজপুর থেকে সেই কবে এসেছি, তারপর আর আমার খবর রাখে নাই কেউ। একবার মা-বাবা, ভাই-বোনকে খুব মনে পড়লো। খুব মনে পড়লো খেলার সাথীদের। কারণ আমি চৌদ্দ বছর পর্যন্ত সবার সঙ্গে হেসে-খেলে সময় কাটিয়েছি। মনটাকে যেনো বেঁধে রাখতে পারছিলাম না। তাই ছুটে গেলাম সবার সঙ্গে দেখা করতে।

আট বছর পরে আমাকে সবাই দেখল। কিন্তু তাদের কারো মাঝেই আমার জন্য কোনো আগ্রহ দেখলাম না। সবাই আমাকে এড়িয়ে চললো। তিন দিনের মাথায় আমার গর্ভধারিণী মা আমাকে বাড়ির পুকুর পাড়ে ডেকে নিয়ে বললো, বলতো তুই যাবি কবে মা?

আমি সেই দিনই চলে এসেছি। এই ঘটনার পরও প্রতিদিনই বাড়ির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে সবার কথা। আমার ছোট একটা ভাই ছিল। সেই যে কত তার দুষ্টামি! বলেই আশার অঝোরে কান্না। পাশে বসে কাঁদছিল আরেক হিজড়া নুপুর। চারপাশে উৎসুক জনতার ভিড়। তারা যেনো হিজড়া দেখছে না, দেখছে একজন পরিপূর্ণ দুঃখী মানুষকে।

পুস্পিতা হিজড়া (২২)। থাকেন পুরান ঢাকায়। শাহবাগে আসেন মাঝেমধ্যে। পাবলিক লাইব্রেরির সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। নাম জানতে চাইতেই বললেন, নাম জেনে আর কি হবে, আমরাতো মানুষ নই,মানুষ রূপী অসামাজিক জীব। এরপর পাবলিক লাইব্রেরীর সামনের সিড়িতে বসে কথা বলতে শুরু করলেন। বললেন, অনেক দিন আগের কথা। আমি তখন ময়মনসিংহ শহরে হাইস্কুলে পড়ি। আমি ছিলাম ওই স্কুলের মেধাবীদের একজন। খেলাধুলায় সব সময়ই প্রথম থাকতাম। নাচগানেও আমার সঙ্গে কেউ পাল্লা দিয়ে পারতো না। আমি যখন সেভেনে পড়ি তখন থেকে আমার কণ্ঠস্বর পুরুষের মতো হয়ে গেলো। শরীরেও একটা অস্বাভাবিকতা অনুভব করলাম। কিন্তু প্রকাশ করলাম না কারও কাছে। পরীক্ষা দিয়ে অষ্টম শ্রেণীতে উঠলাম। শুরু হলো টিচার এবং সহপাঠিদের নানা কটুক্তি। হঠাৎ একদিন সকালে হেড টিচার আমাকে স্কুল থেকে বের করে দিলেন। এর একটাই কারণ ছিলো আমি একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। এ সমাজে আমার কোন ঠাঁই নেই। যেদিন আমাকে স্কুল থেকে বের করে দিলেন সেদিন বাসায় ফিরে আমি আমার রুমের দরজা বন্ধ করে দেই। দুই দিন দরজা বন্ধ করে শুধুই কেঁদেছিলাম।

এই দুই দিন আমি কিছুই খাইনি। মা বার বার জিজ্ঞেস করেছে-কি হয়েছে তোর। মাকে কিছুই বলিনি। কারো সঙ্গে কোন কথাও বলিনি। কিন্তু কিছুদিন পর আস্তে আস্তে ঘটনাটা জেনে গেলো আমার পরিবারের লোকজন। আমার জন্মদাতা বাবা ও গর্ভধারিণী মা -এ সম্পর্কে নানা কথা বলতে থাকলেন। সৃষ্টিকর্তার এই বিধান যেনো তারা মানতে নারাজ। আর সমাজের কথাতো বাদই দিলাম। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি পরগাছা হয়ে থাকবো না। তাদের জন্য বোঝা হবো না। একদিন মার্কেটে যাবার কথা বলে অনেকটা জোর করেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। আজ প্রায় সাত বছর হতে চলেছে বাড়ি থেকে এসেছি। আজ কতো দিন হয়ে গেছে-বাবা মার মুখটা দেখি না। জানতে পারি বাবা পত্রিকায় আমার নিখোঁজ সংবাদ দিয়ে একটি খবর ছাপিয়েছিলেন। তার কিছু দিন পর একটি মোবাইলের দোকান থেকে আমি বাবাকে ফোন করি। বাবা আমার কণ্ঠ শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। জানতে চান আমি কোথায় আছি। আমি বাবাকে বলিনি আমি কোথায় আছি। শুধু বলেছি আমি যেখানে আছি ভালো আছি। আমার জন্য কোনো চিন্তা করবেন না। এরপর আমি ফোনের লাইনটা কেটে দিয়ে চলে আসি।

তারপর বাবা সেই নাম্বারে আবার ফোন করে ঠিকানা নিয়ে আমাকে খুঁজে বের করেন। একদিন বাবা-মা দুজনেই আসেন আমাকে নিতে। তখন বলি তোমরা যে সমাজে বাস কর আমার সেখানে জায়গা নেই। মনে অনেক কষ্ট হয়। অনেক কষ্টে তাদের ফিরিয়ে দেই। পুস্পিতা বলেন, আমি আমার এই সমস্যা আগে থেকেই জানতাম। লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে কোনদিন এ বিষয়ে কিছু বলিনি। এমন কি আমার বাবা মাকেও না। আমি যেদিন বাসা থেকে বের হয়ে যাই সেদিন আমার এক বন্ধুর বাড়িতে থাকি। এরপর এক হিজড়ার সঙ্গে ঢাকায় চলে আসি। তিনি নিয়ে যান সরদারের কাছে। তার কাছে আমি আমার সমস্যার কথা বলি। এরপর তিনি আমাকে সেখানে থাকার অনুমতি দেন। কোনদিন কি বাড়ি ফিরে যাবেন এমন প্রশ্নের জবাবে পুস্পিতা বললেন, আপনার কি মনে হয়, এখানে আমরা যারা আছি, খুব সুখে আছি? আমাদেরকে কেউ মানুষ বলে মনে করেনা। তারা আমাদেরকে নিয়ে মজা করে। কে থাকতে চায় এমন পরিবেশে? আমাদেরওতো ইচ্ছে করে বাবা-মার সঙ্গে থাকতে, পরিবারের সবার সঙ্গে চলাফেরা করতে। কিন্তু সমাজে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই যে, আমরা সমাজের সবার সঙ্গে বাস করতে পারি।

মোহাম্মদপুর বেরিবাঁধে কথা হয় নওসিন (ছদ্মনাম) হিজড়ার সঙ্গে। জীবনযাত্রার বর্ণনা করতে গিয়ে নওসিন বলেন, এই জগতে আমাদের মতো হতভাগা আর নেই। ছোট বেলায় স্কুলে গেলাম। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সহপাঠীদের সঙ্গে নিজের পার্থক্য ফুটে উঠতে লাগলো। আর শুরু হলো উপহাস। স্কুলে আর যাওয়া হলো না। একদিন আখাউড়া স্টেশনের কাছের এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হলো। সে আমাকে প্রেম নিবেদন করলো। আমারও ভালো লাগলো তাকে। প্রেমে পড়ে গেলাম। চিঠি আদান প্রদান হলো। একদিন সে আমাকে বললো চলো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি। তখন তাকে বললাম, আমিতো হিজড়া। এ কথা শোনার পর তার কি যে কান্না। চোখের জলে বুক ভাসালো। সেই থেকে আমি বদলে গেলাম। বললেন, আমাদের হৃদয়ে ভালোবাসা থাকতে হয় না। ইচ্ছে হলেও ওসবের কিছু করার জো নেই।

নওসিন তার স্মৃতিবিজড়িত অতীত বর্ণনা করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় উদাসীন থাকার পর আপন মনেই টান দিলেন গানে। আমি কূল হারা কলঙ্কিনী…। গান থামিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে উদাস কণ্ঠে নওসিন বললেন, ওসব কথায় আর কাজ নেই। আমাদের কথা শুনে তোর কোনো লাভ নেই। তুই বাসায় যা। কিছুক্ষণ অনুনয় বিনয় করায় আবার কথা শুরু করলেন। বললেন, আমাদের তো আর সন্তান হয় না, আমাদের সংসার বলতে আমরাই। পেট চালাতে দোকানে দোকানে তোলা তুলি, পাড়ায়-মহল্লায় গিয়ে বাচ্চা নাচাই। যা পাই তাই দিয়ে খেয়েপড়ে আছি। আমাদের কেউ বাসা ভাড়া দেয় না। থাকি বস্তিতে ভাঙাচুরা ঘরে। সরকার যদি আমাদের দিকে সুনজর দিতো তাহলেতো একটু ভালো থাকতাম।

দুই মাস আগে যার নাম ছিলো নিরব খান। তিনি এখন হেনা হিজড়া। তিনি এখন আছেন শ্যামপুর হিজড়াপল্লীতে। সেখানে ববি হিজড়ার ডেরায় বসে কথা হয় তার সঙ্গে। হেনার বাড়ি খুলনা শহরে। বাবা ব্যবসায়ী। তারা তিনভাই বোন। হেনা বলেন, আমার বয়স যখন ৬-৭ বছর তখন বিষয়টা আমার মার কাছে ধরা পড়ে। আমার তখন থেকেই রান্নাবান্না, ঘরের কাজ বেশি ভালো লাগতো। সকলের অগোচরে মায়ের কসমেটিকস দিয়ে সাজতাম, শাড়ি-ব্লাউজ পড়তাম। খুব ভালো লাগতো। স্মার্ট কোন পুরুষ দেখলে মন চাইতো তাকে আমার বয়ফ্রেন্ড হিসেবে দেখতে। এটা নাকি আমার হরমোন সমস্যার কারণে হতো। আমার হাটা-চলাও ছিল মেয়েলী-মেয়েলী। চলন-বলন দেখে মানুষ আমাকে নানা কটুক্তি করতো। আর আজেবাজে কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগতো। যে কারণে পুরুষদের সঙ্গে মিশতে আমার লজ্জ্বা লাগতো। হেনা জানান, ২০০৮ সালে খুলনা সিটি কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাস করেছেন। এরপর এলএলবি অনার্স ভর্তি হন নর্দান ইউনিভার্সিটির খুলনা ক্যাম্পাসে। সেখানে দুই সেমিস্টার শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, আমার ছোট ভাই ছাত্রদল নেতা। সে প্রায়ই বাসায় এসে আমাকে বকাঝকা করতো। তার বন্ধুরা নাকি আমার সম্পর্কে তাকে আজে বাজে নানান কথা বলে। একদিন সে আমাকে মারধোর করে। একপর্যায়ে মোমবাতি দিয়ে আমার গাল পুড়িয়ে দেয়। এরপর আমি বাড়ির ছাদে যাই আত্মহত্যা করতে। মা দেখে ফেলায় আত্মহত্যা করতে পারিনি। তারপর অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাই। চলে আসি এখানে। এখন আমি হিজড়া। হিজড়াগিরী করে যা পাই তা দিয়ে পেটের ক্ষুধা মিটাই।

দেশে অনেক পুস্পিতা, আশা, নওসিন ও হেনা আছে যাদের অসাধারণ মেধা থাকার পরেও তারা ঠাঁই পায়নি এ সমাজে। পড়তে পারেনি কোনো স্কুলে। কাজ করতে পারেনি সাধারণ কোনো প্রতিষ্ঠানে। চলাফেরা করতে পারেনি কোনো স্বাভাবিক মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

এ প্রসঙ্গে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সরকার হিজড়াদের বিষয়টি ভাবতে শুরু করেছে। সরকারী পর্যায়ে এদের পুনর্বাসনের বিষয়টি আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। সমাজের মূল স্রোতে এদের মেশার সুযোগ সৃষ্টির জন্য জোড়ালো পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সমাজের সদস্য হিসেবে হিজড়াদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তাদের যেন কারোর কাছে হাত পাততে না হয়-সেজন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ। তিনি আরও বলেন, হিজড়াদের বাধ্যতামূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে। হিজড়াদের অনেকে পুরুষ বা নারী হিসাবে ভোটার হলেও নিজ পরিচয়ে ভোটার হওয়ার সুযোগ নেই। এমনকি পরিচয় জানার পর কোন প্রতিষ্ঠান তাদের চাকরি পর্যন্ত দেয় না। ফলে তারা চিকিৎসা, আইনী সুবিধা, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিকানা, সুস্থ জীবনযাপনের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তিনি বলেন, হিজড়ারা আলাদা কোন সম্প্রদায় নয়। তারা এ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের জন্য সমাজে একটা জায়গা করে দিতে হবে। কারণ তারা আমাদের মতোই মানুষ। তাই তাদের সুস্থ ও সাবলীল জীবনধারণের নিশ্চয়তা বিধান করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, পারিবারিক পর্যায়ে এমন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে একজন হিজড়া শিশু অন্য শিশুদের মতো আচরণ পায়। হিজড়া শিশুটিকে যাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা না হয়। এসব শিশু পরিবারে এবং সমাজে হিজড়া হিসাবে বিবেচিত না হয়ে অন্যসব স্বাভাবিক শিশুর মতো মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি এবং স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে সকলের সচেতনতা বাড়াতে হবে। এজন্য প্রচার খুবই জরুরি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top