GuidePedia

0
 ওরা ২৩ জনের একটি দল। তাদের কেউ কৃষক, কেউ দিনমজুর, কেউবা ছাত্র। সবাই রাতের আঁধারে মিলেছেন একই ভবনের নিচে। এসেছেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে। কেউ এসেছেন সিরাজগঞ্জ, কেউ টাঙ্গাইল কিংবা কিশোরগঞ্জ এবং মুন্সীগঞ্জ থেকে। সবার উদ্দেশ্য একটাই, কম টাকায় স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া গমন। নিশ্চিত ঝুঁকি জেনেও সেজন্য তারা দ্বারস্ত হয়েছেন আদম ব্যাপারীর কাছে।
পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই স্বপ্নের মালয়েশিয়ায়!

কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে কোনোভাবে বাংলাদেশের জলসীমা পার হতে পারলেই পৌঁছানো যাবে স্বপ্নের মালয়েশিয়ায়। শর্ত একটাই ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিতে হবে। টাকা দিলেই আদম ব্যাপারীরা তাদের পৌঁছে দেবে সেখানে। কাঙ্ক্ষিত সেই উদ্দেশ্য সাধনে এই ২৩ জনের দলটি শুক্রবার একত্রিত হয় নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন খতিবের হাটের নির্মাণাধীন ভবনে। সেখান থেকে ২৩ নভেম্বর সকালে টেকনাফ হয়ে সাগর পথে মালয়েশিয়া গমনের কথা ছিল তাদের। বাংলাদেশের বাইরে কোনো দেশে অবস্থান করতে সে দেশের ভিসা ও কাজের অনুমতিপত্র প্রয়োজন হলেও তাদের কারো কাছেই ছিল না ভিসা-পাসপোর্ট কিংবা অনুমতিপত্র।

কিন্তু বিধিবাম তাদের সেই স্বপ্নের যাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়ালো নগর পুলিশের সহকারি কমিশনার (পাঁচলাইশ) শাহ মোহাম্মদ আব্দুর রউফের নেতৃত্বে পুলিশের একটি অভিযান টিম। পুলিশ শুক্রবার গভীর রাত ৩টায় অভিযান চালিয়ে ওই ভবন থেকে উদ্ধার করে মালয়েশিয়াগামী ২৩ ব্যক্তিকে। সেই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় বাড়ির মালিকসহ মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত ৬ জনকে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- মানবপাচারের মূলহোতা চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ইসমাইল (২৪), আঁচন (৩০), ইউনুস (৪৬), নগরের চান্দগাঁওয়ের বাড়ির মালিক মহসিন (৫০), কক্সবাজার সদরের মোবারক হোসেন (২৩), নুরু নবী (৩০)।

পুলিশ জানায়, এরমধ্যে ইসমাইল চট্টগ্রামের লোকাল এজেন্ট হিসেবে সারাদেশ থেকে অবৈধপথে মালয়েশিয়াগামী মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের কাজটি করেন। চট্টগ্রামের অধ্যায়টি শেষ হওয়ার পর টেকনাফে এই ২৩ জনকে গ্রহণ করতেন আরেক আদম ব্যবসায়ী শফিক। সে টেকনাফ থেকে ট্রলারে করে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর দায়িত্বটি সারানোর পর মালয়েশিয়ার সমুদ্র থেকে তাদের গ্রহণ করার কথা ছিল শফিকের বড় ভাই মালেয়শিয়া প্রবাসী আলীর। এভাবেই প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে শেষ হতো আদম ব্যবসায়ীদের মানবপাচার মিশন।

নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (পাঁচলাইশ) আব্দুর রউফ জানান, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন খতিবের হাট এলাকার নির্মাণাধীন একটি ভবনে মালয়েশিয়া পাচারের জন্য জড়ো করা ২৩ জনকে উদ্ধার করা হয়। তাদের দেশের বিভিন্নস্থান থেকে সেখানে এনে রাখা হয়েছিল। সুবিধামতো সময়ে তাদের টেকনাফের নাফ নদী হয়ে ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় পাচার করে দেয়া হতো। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম সাইডের মূলহোতা ইসমাইলসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচার প্রতিরোধ আইন ২০১২ ধারা মোতাবেক একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।’

সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রাক্কালে পুলিশের হাতে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- সিরাজগঞ্জের শান্তা আলী (২৪), আশরাফুল (২৩), রফিকুল ইসলাম (২৪), রুহুল আমিন (২৫), নরসিংদীর আল আমিন (২৩), হাবিবুর মিয়া (২৫), মাসুদ মিয়া (২৫), হানিফ মিয়া (৩৯), মাসুদ রানা (২৬), সেলিম (৩০), বাকিল (১৮), স্বপন ভূইয়া (২৪), নারায়ণগঞ্জের রুহুল আমিন (২২), রফিকুল ইসলাম (২২), ইকবাল মিয়া (২০), মুন্সীগঞ্জের নুর ইসলাম (২৮), শুক্কুর ব্যাপারী (৩৩), টাঙ্গাইলের রফিকুল ইসলাম (৩০), আশরাফ আলী (২৬), রফিকুল ইসলাম (৩১), হাবিবুর রহমান (২৫), কিশোরগঞ্জের তাজুল ইসলাম (২৩) ও কক্সবাজারের নুরুল আজিম (৩১)।

টাঙ্গাইলের রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত সাত দিন আগে একজনের মাধ্যমে আদম ব্যাপারী ইসমাইলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে আমার কথা হয়। ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে সমুদ্রপথে ট্রলারে করে ইসমাইল মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে বলে জানায়। নির্ধারিত সময়ে আমাকে চট্টগ্রামে আসতে বলেন। শুক্রবার ছিল সেই নির্ধারিত সময়। টাঙ্গাইল থেকে একই দলের হয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য আমরা ৪ জন চট্টগ্রামের খতিবের হাটে আসি শুক্রবার দুপুরে।’

তিনি বলেন, ‘ইসমাইলের সঙ্গে আমাদের টাকার চুক্তি হয় মালয়েশিয়ায় পৌঁছতে পারলেই তখন আমাদের পরিবারের লোকজন তাদের সঙ্গে চুক্তিকৃত ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা প্রদান করবে।’ তবে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাত্রার কথাটি জানতেন না বলে দাবি করেন টাঙ্গাইলের এ কৃষক।

কিশোরগঞ্জের ছেলে ডিগ্রি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তাজুল ইসলাম পড়ালেখা শেষ না করেই বেশি অর্থ উপার্জনের আশায় অবৈধ যাত্রা জেনেও পারি দিতে চেয়েছিলেন সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায়। এজন্য তিনি টাঙ্গাইলের রফিকুলের মতো স্থানীয়ভাবে আদম ব্যাপারীর মাধ্যমে ইসমাইলদের তত্ত্ববধায়নে থাকার জন্য চট্টগ্রামে আসেন শুক্রবার দুপুরে।

তাজুল বলেন, ‘এলাকার এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে ইসমাইলদের সঙ্গে আমার পরিচয়। মালয়েশিয়া যেতে পারলে ভালো বেতনের চাকরি দেয়ার কথা বলে আমাদের এখানে আনা হয়। তাদের কথার উপর বিশ্বাস করেই এখানে এসে দেখি সব মিথ্যা।’

উদ্ধার হওয়া ২৩ জনের কারো কাছেই ছিল না মালয়েশিয়া যাওয়ার ভিসা, পাসপোর্ট ও টিকিট। এরপরও তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল তারা ঠিকই ট্রলার বা জাহাজে করে মালয়েশিয়া যাবে। স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া যাওয়ার যাত্রীদের শেষ সম্ভল ছিল একটি বিস্কুটের প্যাকেট আর ১০০ গ্রাম চিড়া। তাদের পরনের কাপড়েও ছিল দারিদ্রতা আর মলিনতার ছাপ।

মুন্সীগঞ্জের শুক্কুর আলী বলেন, ‘মানবপাচারকারী ইসমাইল বলেছেন কোনো রকমে সাগরের পথ ধরে ট্রলারে উঠতে পারলেই হয়। এজন্য কোনো ধরনের পাসপোর্ট-ভিসা বা টিকিটের প্রয়োজন পড়বে না। তাই আমরাও তাদের কথা বিশ্বাস করে কোনো রকমে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু রাতে পুলিশ ধরে নিয়ে আসায় সেই আশা ব্যর্থ হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top