রাজধানীতে আটটি ‘প্রেমিকা চক্রের’ ভয়ঙ্কর প্রেমের ফাঁদ (ভিডিওসহ)

ফোনের ওপাশ থেকে কোনো তরুণীর সুমিষ্ট কণ্ঠ শুনে প্রেমে পড়ছেন। সাবধান! ভালোভাবে খোঁজ নেওয়ার আগে এমন তরুণীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই বিপদ। রাজধানীতে অন্তত আটটি চক্র প্রেমের এমন ফাঁদ পেতে প্রতারণা করে আসছে।

ধনাঢ্য ব্যক্তি, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, প্রবাসী ও রাজনৈতিক নেতাদের টার্গেট করে তৈরি করা হচ্ছে ‘প্রেমের ফাঁদ’। এর পর দিনের পর দিন ডেটিং করে এক সময় কৌশলে কোনো ফ্ল্যাটে নিয়ে তোলা হয় আপত্তিকর ছবি। এই ছবি নিয়ে আবার একই চক্রের সদস্যরা ভুয়া পুলিশ সেজে থানায় মামলা করার হুমকি দেয়। একইসঙ্গে ভুয়া সাংবাদিক সেজে গণমাধ্যমে প্রকাশেরও হুমকি দেওয়া হয়। এর পর প্রতারিত ব্যক্তির কাছ থেকে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা।

গত ৯ এপ্রিল রাজধানীর পাইকপাড়া থেকে এমন চক্রের দুই নারী সদস্যসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে দুই মামলায় আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রিমান্ডে তারা যেসব তথ্য দিয়েছে, তা রীতিমত চমকপ্রদ ও অভিনব। এখন রাজধানীতে একই ধরনের আটটি দল সক্রিয়। তাদের মধ্যে ‘শিকদার’ আর ‘কল্পনার’ গ্রুপে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সদস্য রয়েছে। এসব গ্রুপে নামিদামি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণীরা জড়িত। মোহাম্মদপুরে ‘জিয়া’ ও মিরপুরে ‘আফরোজা’র দল সক্রিয়।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি ( দক্ষিণ) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, যারা এ ধরনের প্রতারকের ফাঁদে পড়েছেন, তারা বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানালে জড়িতদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। অনেকেই লোকলজ্জার ভয়ে মামলা করতে চান না।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘এ ধরনের প্রতারকদের গ্রেফতার করা বেশিরভাগ সময় কঠিন হয়ে পড়ে। প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তাদের শনাক্ত করতে হয়। রাজধানীতে আরও আটটি দলের খোঁজ পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, প্রেমের ফাঁদ ফেলে প্রতারণার সঙ্গে জড়িত রাজধানীর সক্রিয় আটটি গ্রুপের মধ্যের অধিকাংশের দলনেতা পুরুষ। নারায়ণগঞ্জের শিকদারের হাত ধরে এমন প্রতারণা শুরু হয়। তাকে অনুসরণ করেই পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি দল সক্রিয় হয়। শিকদার নারায়ণগঞ্জের হলেও তার দল রাজধানী ঘিরেই সক্রিয়। প্রতিটি দলের সদস্য ৬ থেকে ১০ জন। দলের পুরুষ সদস্যের প্রাথমিক কাজ কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তির মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করা। সাধারণত ৫০ বছরের বেশি বয়স্ক ব্যক্তিকে তারা টার্গেট করে। এর পর টার্গেট করা ব্যক্তির মোবাইলে মিসড কল দেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তি ওই নম্বরে ফোন করলে সুমিষ্ট কণ্ঠে ‘দুঃখ’ প্রকাশ করা হয়। এতে কোনো কোনো ব্যক্তি ওই তরুণীর সঙ্গে নিজ থেকেই আলাপ জমানোর চেষ্টা করেন। আবার কোনো টার্গেট করা ব্যক্তি মিসড কলের সূত্র ধরে কল না করলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আবার ফোন করে আলাপ করার চেষ্টা করা হয়। দিনের পর দিন কথা বলার পর প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করা হয়। এর পর ডেটিংয়ের জন্য কোনো এলাকায় ডাকা হয়। এর সূত্র ধরেই টার্গেট করা ব্যক্তিকে কোনো এক সময় ফ্ল্যাটে নিয়ে রাত কাটানোর প্রস্তাব দেয় তরুণী। সেখানে রাত কাটানোর পর ভোরে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়তে থাকে পুলিশ পরিচয়ধারী ৩-৪ সদস্য। তাদের হাতে থাকে ওয়াকিটকি ও নকল অস্ত্র। তাদের সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে হাজির হন ভুয়া সাংবাদিক। জোরপূর্বক তরুণীর সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলতে বাধ্য করা হয়। এর ব্যত্যয় হলে থানায় মামলা ও পত্রিকায় প্রকাশের হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা চাওয়া হয়। এর পর লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে না জানিয়ে টাকা দিতে বাধ্য হন প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা। এর পরও বিভিন্ন সময় আপত্তিকর ছবি প্রকাশের ভয় দেখিয়ে টাকা দিতে বাধ্য করে ওই চক্রের সদস্যরা।

পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এসব চক্রের সদস্যরা সাধারণত মাসে একজনকে টার্গেট করে। নিজেদের মধ্যে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের সময় তারা সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করে। ‘আজ বিয়া পড়ানো হবে’ বলতে টার্গেট করা ব্যক্তির সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তোলার দিনকে নির্দেশ করে। এমন প্রতারণার সফল পরিসমাপ্তির পর প্রতারক চক্রের অধিকাংশ সদস্য তাদের সব মোবাইল সিমকার্ড ফেলে দিয়ে ঢাকার বাইরে চলে যায়। কিছুদিন সেখানে থাকার পর আবার রাজধানীতে এসে নতুন টার্গেট ঠিক করে। ঢাকায় সক্রিয় আট চক্রের অধিকাংশের গ্রামের বাড়ি খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট এলাকায়।মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ইতিমধ্যে এ চক্রের ফাঁদে পড়েছেন সমাজের এমন আট বিশিষ্ট নাগরিকের তথ্য তাদের হাতে রয়েছে। রাজধানীতে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী, সিরাজগঞ্জের একজন রাজনৈতিক নেতা, সিলেটের একজন ধনাঢ্য প্রবাসী, গুলশানের একজন সাবেক সাংসদ, মিরপুরের দু’জন ব্যবসায়ী তাদের মধ্যে অন্যতম। লন্ডন প্রবাসী এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২৪ লাখ টাকা নিয়ে গেছে প্রতারক চক্র। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সরকারি এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছ থেকে একইভাবে ১৭ লাখ টাকা নিয়ে যায় ওরা।