GuidePedia

0


শীতের সকালটায় হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে স্যারের বাসায় পড়তে গিয়ে দেখি বাগানের পুরনো বেদিটায় একা একা বসে আছেন। বললেন, 'আজ পড়াব না রে, মনটা ভালো নেই'। সবাই খুশি মনে ফিরতে শুরু করতেই ডেকে বললেন, 'আশালতা, তুমি থাকো, তোমার সাথে কথা আছে'। আমি অবাক হওয়ার চেয়ে চিন্তিত হলাম বেশি। কারন একা ফিরতে হবে। তার মানে রোজদিন দরজার আড়ালে গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা উনার পাগল ছেলেটার সামনে দিয়ে একাই যেতে হবে, এইটাই চিন্তার।
আমাদের এই স্যারকে দেখে মনেই হতনা উনি অত ভালো ইংরেজি জানেন। পাজামা পাঞ্জাবী পড়া বেঁটে খাটো মুসল্লি টাইপ মানুষ। মুখে স্নিগ্ধ হাসিটি লেগেই রয়েছে। শুধু যখন ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা শেলি-কিটস পড়াতে শুরু করতেন, গমগমে গলাটা আবেগে কেঁপে যেত। ভুলভাল উচ্চারন করে ফেললেই দুঃখিত গলায়, 'আহা, ওভাবে নয় মা, এই ভাবে', বলে অসীম ধৈর্যের সাথে ফনেটিক্স শেখাতে শুরু করতেন। আমি চকিতে একবার দরজার ওপাশের ছায়ামূর্তির দিকে ভয়েভয়ে তাকিয়ে পড়ায় মন দেবার চেষ্টা করতাম।
স্যারের সামনে আপাতশান্ত একটা ভাব নিয়ে সেদিন বেদিটায় বসলাম। দীর্ঘক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলেন,'আমার জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছে, কাউকেই বলতে পারছিনা। তুমি তো লেখালেখি কর, তুমি বুঝবা জিনিষটা'। একটু বিরতি দিয়ে কেমন বিব্রত গলায় বললেন, 'আমার সাথে চল্লিশ বছর পর একজনের দেখা হয়েছে। বলতো, সে কে হতে পারে ?' আমি অনেক মাথা ঘামিয়ে বললাম, 'দেশভাগের সময় আলাদা হয়ে যাওয়া আত্মীয়'! স্যার বাধা দিয়ে আহত গলায় বললেন, 'না না, সেরকম নয়... ওকে আমি...মানে... খুব পছন্দ করতাম'। এইবার আমার মোটা মাথায় ঢুকল ,কিন্তু কি বলতে হবে বুঝলাম না। তাই চুপ করে রইলাম। স্যার নিচু গলায় সেই হারিয়ে পাওয়া ভাললাগার কথা বলতে লাগলেন। আসলে বোধ হয় উনি ঠিক অন্য কাউকে নয়, নিজেকেই বলছিলেন কথাগুলো । আমার আনাড়ি মস্তিষ্কে কিছুই গেলনা, শুধু মন খারাপটা আন্দাজ করলাম। কথা শেষে বললেন, 'কাল যেতে বলেছে ওর বাসায়, যাব কিনা বুঝছিনা, যদি যাই, তোমাকে জানাবো'। আমার জানা দরকার কেন, তা না বুঝলেও ছাড়া পাওয়ার খুশিতেই মাথা ঝাঁকিয়ে দিলাম ছুট। গেটের মুখে এসে দেখি গোলাপ হাতে ছায়ামূর্তি হাজির। বলল, 'আশালতা, আমাক বিয়া করবা ?' আর বিয়া ! আঁতকে উঠে দেদ্দৌড়। পাগলের ভয়ে স্যারের বাড়ি আর যাওয়া হলনা, অসমাপ্ত প্রেমকাহিনী অজানা রয়ে গেল ।
অনেক বছর বাদে, এক দুপুরে ছোট শহরটায় ফিরে পুরনো কলেজটায় গেলাম । করিডোর ধরে হেঁটে যেতে যেতে দেখি ঠিক আগের মতো করেই স্যার ম্যাডামরা ক্লাস নিচ্ছেন... দপ্তরি বুড়োর মুখে আরও কটা বলিরেখা পড়েছে আর গাছগুলো যেন আরও উঁচু উঁচু হয়ে উঠেছে। সামনের বাগানটায় ঝাঁক বেঁধে পায়রাগুলো বকম বকম করছে অনেক আগের মতই। কোন কিছুই আর তেমন পালটায় নি ।
প্রায় ফাঁকা কমন রুমে যেতে দু চারজন চেনা টিচারের সাথে দেখা হল। একজন পুরনো দিনের গান শুনছিলেন, এসময় দরজা ঠেলে ঢুকলেন আমাদের যুক্তিবিদ্যার মজিদ স্যার । ভীষণ আবেগ দিয়ে লজিক পড়াতেন বলে আমরা ডাকতাম 'অযৌক্তিক স্যার'। আমাকে দেখে অন্যদের মতই খুশি হলেন খুব । কেমন বুড়োটে হয়ে গেছেন, চেহারায় দীর্ঘ অসুস্থতার ছাপ। প্রাথমিক কথাগুলো শেষ করে টুকটাক কথা বলতে বলতে একসময় চুপ করে গেলেন। আড্ডাগুলোয় যেমন হয়, হটাৎ সবাই চুপ মেরে যায়, তেমন। পুরনো খোলা জানালাটার বাইরে কতগুলো কাক খা খা করে ডেকে উঠতে পায়রাগুলো ঝপাৎ করে দল বেঁধে উড়ে গেল ডানা ঝটপটিয়ে। স্তব্ধ দুপুরের ক্লান্ত বাতাসে শুধু লতার গান ঘুরে ঘুরে বাজতে থাকল, 'প্রেম একবার এসেছিল নীরবে......। সেই গান শুনতে শুনতে সেই থমকে যাওয়া নিরব দুপুরে হটাৎ, হটাৎই মজিদ স্যার, 'এই গান তোমরা কেন বাজাও!' বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কেউ কিছু বলতে পারলনা। একটু পরে চোখ মুছে উনি উঠে চলে গেলেন। আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইলাম।
বাসায় ফিরলাম মন খারাপ করে। সন্ধ্যায় এলেন পড়শি দাদু। এইয়া লম্বা চওড়া মানুষ, গমগম করে কথা বলেন, ঠা ঠা করে হেসে উঠে মানুষের পিলে চমকে দেন। এসেই ধমকে বললেন, 'কিরে, মুখ ভোঁতা করে ঘুরছিস কেন ?' মজিদ স্যারের ঘটনাটা বলতেই হো হো করে হেসে উঠেই কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষন কি ভেবে বলে বসলেন, 'আমারও একটা মেয়েকে ভারী ভালো লাগত জানিস...এত অভিমানী ছিল...একদিন রাগ করে বিষ খেয়ে ফেলল...'। তারপর একটু চুপ থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বললেন,'আজ যাইরে, বাসায় কাজ আছে'।
পেছন থেকে দেখলাম লম্বা মানুষটা একটু ঝুঁকে কেমন ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে বের হয়ে গেলেন। তারপর হাস্নাহেনা ঝোপটার পাশে একটু দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে জামার হাতায় আলগোছে চোখদুটো মুছে নিয়ে পথের বাঁকে হারিয়ে গেলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top