GuidePedia

0
মরিচা ধরা ভাঙ্গা টিনের জোড়াতালি দেয়া দেয়াল। ছেঁড়া নীল পলিথিনে মোড়ানো ছনের ছাঁদ। ছোট্ট ঘরটাকে আরো ছোট দুটো টুকরো করেছে বাংলা সিনেমার পোস্টার জুড়ে বানানো দেয়াল। সে দেয়ালেরও এখানে সেখানে ফুটো হয়ে গেছে। উচ্চবিত্তদের বাসের এলাকার মাঝে ভীষণ খাপছাড়া লাগে ঘরটা। আসলে জমির মালিক এখানে পাহারা দেয়ার জন্য থাকতে দিয়েছেন নিজের গ্রামের একটা ছেলেকে। এই ছেলেকে মাসে মাসে কিছু টাকাও দেন জমির মালিক। কিছুদিন পরে এখানে উঠবে বিশাল সুরম্য অট্টালিকা। তখন আর এই জীর্ণ ঘরের ছাপ খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
এই জমিটার তিনপাশে এখুনি উঠে গেছে বিশাল সব বাসা। সামনে রাস্তা। শোনা যায় এখানে এক শতক জমির দাম দুই-আড়াই কোটি টাকা! গ্রামের সেই ছেলে যার নাম রহমান। সে বসে ভাবে তার পুরো গ্রাম বিক্রি করলেও বোধহয় এতো দাম হবেনা! কোথায় পায় মানুষ এতোগুলো টাকা? খানিকপরেই হিসেব গুলিয়ে যায় রহমানের। ঘরের ভেতর থেকে রহমানের বাবা ডাকে রহমানকে। রহমান উঠে বাবার কাছে যায়।
রহমানের বাবা অসুস্থ। হার্টের রোগে যায় যায় অবস্থা। একটুতেই ধুক-ধুক করে বুকটা। কিছুদিন হলো আরো অসুখে কাহিল হয়ে গেছে। বাবাকে ডাক্তার দেখাতে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে রহমান। ছোট্ট ঘরকে আরো ছোটো করে দু’টো ভাগ করে একপাশে সে থাকে। আরেকপাশে থাকে ওর বাবা। কারণ একটু শব্দেই বাবার খুব কষ্ট হয়। আলাদা ঘর করে যদি একটু শান্তি দেয়া যা বাবাকে! রহমানের মা নেই। সেই কবে মারা গেছেন। আপন বলতে শুধু বাবাই আছে ওর। বাবাকে ঘিরেই ওর জীবন। ভীষণ ভালোবাসে সে বাবাকে। বাবাই সব। তাই বাবাকে বাঁচিয়ে রাখতে ওর প্রাণান্ত চেষ্টা।
এভাবে প্রায় তিনমাস হয়ে এলো। বাবার শরীরটা ভালো হচ্ছেনা। বরং দিনে দিনে আরো খারাপের দিকেই যেনো যাচ্ছে। সামান্য জমানো টাকা সব শেষ। এর ওর কাছে ধার করে করেও কিছুই হয়না। মাইনে যা দেয় জমির মালিক তাতেও অগ্রীম নিয়েছে দু’মাসের। হাসপাতাল-ওষুধ এসবের খরচ তো কম নয়! তবুও চেষ্টায় ত্রুটি করেনা রহমান।
বছরের শেষ চলে আসে। নতুন বছর আসবে। রহমান ভাবে নতুন বছরে বাড়ির কাজ শুরু হলেই সে বাবাকে নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। মালিক বলেছেন জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে কাজ শুরু করে দেবেন। তখন আর রহমানের না থাকলেও চলবে। সেই ভালো। অনেকতো চিকিৎসা হলো। এবার গ্রামের হাওয়াতে যদি বাবার দম কিছুদিন বাড়ে!
বাড়লো না দম। জানুয়ারীর এক তারিখের মধ্যরাতে রহমানের বাবা মরে গেলেন। সে রাতে এই জমির ডানের বাড়ির দোতলায় ডিজে পার্টির আয়োজন করেছিলো সেই বাসার ছোট ছেলে। রহমান এতো কিছু জানেনা। সে জানে মধ্যরাতের হই-হুল্লোড় আর ভয়াল আওয়াজে তার বাবা কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। কালো কাঁচের জানালাগুলো বন্ধ থাকলে ওই বাসাগুলো থেকে কোনো শব্দ বাইরে আসেনা। কিন্তু কাল রাতে কে যেনো খুলে রেখেছিলো সবগুলো জানালার কাঁচ। রহমান দেখেছে বাবার চোখে জল। আকুতি বেঁচে থাকার। ইংলিশ গানের ভাষা সে বোঝেনি। সে গানের কথাগুলো তার কানে আজরাইলের হুংকার হয়ে বেজেছে। বাবাকে বাঁচাতে রহমান ও বাড়ির গেটে দৌড়ে গিয়ে শতবার ধাক্কা দিয়েছে। এমনকি মধ্যরাতে কলিংবেলের আওয়াজেও কারো মোহ ভাঙ্গেনি। ওদের চিৎকার ছাপিয়ে রহমান চেচিয়েছে বাবা বাবা বলে! কেউ শোনেনি। রহমান আবার দৌড়ে এসেছে বাবার কাছে। বাবা তখন পানি চেয়ে ছটফট করে। বাবা বলে, ‘বাজান! আমারে তুই বাঁচা! বাজান আমারে মরতে দিসনা বাজান!’
বাবার কথা রহমানের কানে পৌঁছায় না। বাবার আর্তিকে ঢেকে ফেলে মধ্যরাতের উন্মত্ত উল্লাসধ্বনি। অসহায় রহমান ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে বাবার দিকে। বাবার চোখদুটো বুজে আসে। আবার খোলে। মুখজুড়ে তীব্র কষ্টের ঝলসানি। পঁচিশ ওয়াটের বাল্বের ক্ষীণ আলোতে রহমানের চোখ আর দেখতে পারেনা। তার চোখে পৃথিবীটা যেনো বিশাল কোনো অন্ধকারে দলা। সেই রাতেরই কোনো এক প্রহরে চলে যায় রহমানের বাবা।
পরদিন লাশ ভ্যানে তুলতে তুলতে ডান দিকের বিন্ডিংয়ের দিকে সে তাকিয়ে দেখে একবার। কেউ সবগুলো জানালা কাঁচে ঢেকে দিয়েছে আবার। কালো কাঁচে ঢাকা ওই জগতের কেউ জানেনা, আজ সকালে আজিমপুরে থেকে যে কাফনটা তিনশ আশি টাকা দিয়ে কেনা হলো। কাল রাতে জানালাগুলো বন্ধ থাকলে তা আর কিনতে হতো না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top