GuidePedia

0

দেবতাদের মধ্যে সমযৌনতা খুব একটা অপ্রচলিত নয়, যদিও অনেক সময় এগুলি সঙ্গমের চিত্র বহন করে না, বরং আচারে প্রকাশ পায়। অগ্নি অন্য দেবতার বীর্য গ্রহণ করে। যদিও তিনি স্বাহার স্বামী, তিনি সোমের(চাঁদ) সঙ্গে রমণ করেন, কেননা তিনি মুখ দিয়ে পৃথিবীর উৎসর্গ স্বর্গে বসে পান করেন। হিন্দু শাস্ত্র বলে এটি আসলে মিথুন ভঙ্গিমা, যেখানে অগ্নির মুখ যোনির কাজ করে। রামায়ণ আর শৈব পুরাণে যখন পার্বতী আর শিব উপগত হন, তখন দেবতাদের আশঙ্কা হল এই অনন্ত কাল ধরে চলা সঙ্গমে বিশ্বে প্রলয় আসন্ন। এবং তাঁরা বিশ্ব পিতামাতার মিলনে বাধা দান করে। উচ্ছ্রিতদণ্ড রাগান্বিত শিব স্বর্গে উপগত তাঁর অস্খলিত বীর্য কোনও দেবতাকে ধারন করার নির্দেশ দিলে, অগ্নি সেই বীর্য ধারণ করে পান করেন। তবে কথাসরিৎসাগরে বলা হয়েছে শিব অগ্নিকে এটি পান করতে বাধ্য করেন। বেদে মিত্রা আর বরুণের বহু অন্তরঙ্গতার গল্প রয়েছে। ভগবৎপুরাণে এদের দুজনের এক অযোনিসম্ভূত সন্তানের কথা বলা হয়েছে। বরুণের বীর্য বল্মীক স্তুপের ওপর পড়লে বাল্মিকির জন্ম হয়। উর্বশীকে দেখে মিতা এবং বরুণ বীর্য স্খলন করে জলে পড়লে অগস্ত্য আর বশিষ্ঠ্যর জন্ম হয়।

বাঙলায় কৃত্তিবাস রামায়ণে সূর্য বংশের অন্যতম প্রধান রাজা দিলীপের মৃত্যু হলে শিব দুই বিধবা রাণীকে পরস্পরের সঙ্গে উপগত হওয়ার নির্দেশ দেন। একটি হাড়হীন শিশুর জন্ম হয়। পরে অষ্টাবক্র মুনির বরে শিশুটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠেন। নাম হয় ভগীরথ – যে দুটি ভাগে জন্মেছে। ত্রয়োদশ শতকের কাশ্মীরী পুঁথি, জয়দ্রথের হরচরিতাচিন্তামনিতে, পার্বতীর মাসিক নিঃসরণ গঙ্গায় ধুতে ধুতে সেই জল পার্বতীর হাতি মাথা সহচরী মালিনী গলার্ধকরণ করেন এবং মালিনীর ঔরসে হাতিমাথা গণেশের জন্ম হয়। অর্থাৎ গণেশের জন্ম পুরোটাই মহিলা সংসর্গে। শৈব পুরাণে বলা হয়েছে পার্বতী স্নান করতে গেলে মাটির গণেশকে পাহারায় বসিয়ে যান যাতে কেউ না এসে পড়ে। শিব আসলে মাটির গণেশ বাধা দেয়। শিব তাঁর মাথা কাটেন। পরে জুড়ে দেন।

কথাসরিৎসাগরে এক মহিলা অন্য মহিলাকে সম্বোধন করছেন স্বয়ম্বর সখি। আমরা জানি স্বয়ম্বর মানে শুধুই দুটি লিঙ্গের বিয়ে নয়, নিজে নিজের প্রেমাস্পদকে বেছে নেওয়ার অধিকার।

ভারতীয় শাস্ত্রে প্রায়শঃ তৃতীয় লিঙ্গে(প্রকৃতি)র উল্লেখ পাই। নারদ স্মৃতি, বা সুশ্রুত সংহিতায় মহিলা চরিত্রের পুরুষ বা পুরুষ চরিত্রের মহিলার উল্লেখ পাই। সমকামী পুরুষকে মহিলা চরিত্রের পুরুষ বলা হয়েছে। কামসুত্রে সরাসরি বলা হয়েছে, ক্লীবলিঙ্গের মানুষের দ্বৈত সত্তা থাকে। ভারতীয় সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের অবস্থান রয়েছে নিজেদের মত করে। ভারতে হিজড়া, আলি, কোটি – নানান ধরণের সমাজ রয়েছে, নিজেদের পঞ্চায়েত রয়েছে। ভারতের সমাজে দুটি পুরুষের মধ্যে যৌনতাকে মিলন বা সঙ্গম হিসেবে দেখা হয় না।

আমরা যেন মনে রাখি, কোম্পানি আমলে আইন করে তৃতীয় লিঙ্গকে বিনাশ করার চেষ্টা হয়। আমরা দেখেছি অস্কার ওয়াইল্ড জেলে গিয়েছেন। বরং যাকে আমরা রক্ষণশীল ভারত বলে দেগে দিয়েছি, সেই ভারতে হিজড়েরা নিজেদের মত করে সামাজিক সম্মান লাভ করতেন। আজও করেন। শিশু জন্মালে এদের আশীর্বাদ অবশ্যই প্রার্থনীয়। হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় সমাজে তৃতীয় প্রকৃতি নিজেদের মত করে অবস্থান করত। অন্ততঃ ভাজপার আর বামপন্থী আমল ছাড়া হাজার হাজার বছর ধরে হিজড়া বা সমকামিদের নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে নি।

রুথ বিনীতা লাভ রাইটসে স্পষ্ট বলছেন বর্তমান কালে হাজারো সমলিঙ্গে বিয়ের উদাহরণ। গ্রামে দুই মহিলার বিয়ে বন্ধ করতে পুলিস এলে স্থানীয় এক মহিলা বলেন বিয়ে হল দুটি হৃদয়ের মিলন। কে বলেছে দুটি আলাদা লিঙ্গ হতে হবে? New America Media, News Feature, Sandip Roy লিখছেন ব্রাহ্মণদের মধ্যে সমলিঙ্গে বিবাহের কথা। কেউ নিদান দিচ্ছেন পূর্বজন্মে ঠিক ছিল, কেউ বলছেন চিত্তের মিলনের কথা। আসলে ধর্ম শাস্ত্রে তৃতীয় প্রকৃতিকে শাস্তি দেওয়ার বিধান নেই। পুরুষের দেহে নারী প্রকৃতি বা উলটো ধরণের মানুষদের জোর করে বিবাহ দেওয়া হত না (তৃতীয় প্রকৃতিঃ পিপল অব থে থার্ড সেক্সঃ আন্ডারসট্যান্দিং হোমোসেক্সুয়ালিটি – অমর দাস উইলহেম)।

বেদ অনুযায়ী সূর্য, জুপিটার, মঙ্গল পুরুষ, চন্দ্র, ভেনাস আর রাহু প্রকৃতি এবং মারকারি, শনি আর কেতু তৃতীয় বা লিঙ্গহীন নপুংসক(যৌনতারহিত, কিন্তু পুরুষ আর প্রকৃতি(নারী) এই দুই চরিত্র বিশিষ্ট) গ্রহ। শিশুদের যতদিন যৌনতাবোধ না জাগছে অথবা বয়ঃসন্ধিকালে না পৌঁছচ্ছে ততদিন তাদের নিয়ন্ত্রণ করবেন মারকারি। সুশ্রুত সংহিতায় পাঁচ প্রকার ক্লীবের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ১) অসেক্য – যিনি পুরুষের বীর্য পান করে উত্তেজিত হন। ২) সৌগন্ধিকা – যিনি অপরের লিঙ্গের ঘ্রাণে উত্তেজিত হন। ৩) কুম্ভিকা – যিনি পায়ু সঙ্গমে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ৪) ইরশ্যকা – অন্যদের যৌন ক্রীড়া করতে দেখে ঈর্ষায় যৌন উত্তেজনা বোধ করেন। ৫) শন্ধা – যার প্রকৃতি(নারী)র মত চরিত্র। প্রথম চার প্রকার ক্লীব পুরুষের বীর্য পান করে যৌন উত্তেজনা বোধ করে। শব্দকল্পদ্রুমে শন্ধার ২০টি আলাদা প্রকার উল্লেখ করা হয়েছে। সুশ্রুত এবং চরক সংহিতাতে লিঙ্গ জন্মের ১০টি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে - ১) সুকর্ম, ২) কাম, ৩) সংস্কার, ৪) বিকর্ম, ৫) শুক্রবালা, ৬) মিথুনবিধি, ৭) পৌরুষ, ৮) দোষ, ৯) প্রকৃতি, ১০) দৈব।

মূলঃ বিশ্বেন্দু নন্দ, কলিকাতা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top